Skip to content

Latest commit

 

History

History
32 lines (19 loc) · 8.86 KB

‘লিখে-খাওয়া’-লেখকের-দক্ষিণা-সারফুদ্দিন-আহমেদ.md

File metadata and controls

32 lines (19 loc) · 8.86 KB


‘লিখে খাওয়া’ লেখকের দক্ষিণা

সারফুদ্দিন আহমেদ



লেখালেখিও একটা কাজ, অনেকের কাছে এর চেয়ে অদ্ভুত কথা আর নেই। ‘ফুলটাইম’ কবি–সাহিত্যিকদের ‘অকবি’ ও ‘অলেখক’ বউদের কাছে লেখালেখি চিরকালই অনর্থক যন্ত্রণা।

এই দেশে উপন্যাস বা থ্রিলার লিখে যা-ও কিছু টাকা মেলে, কবিতায় তা–ও মেলে না। কবি হিসেবে নাম হয়ে গেলে সভা–সেমিনারে ডাক পড়ে। সেখানে খুব পাকা পাকা কথা হয়। তারপর কবির হাতে দক্ষিণা হিসেবে দুটো গোলাপ ফুল ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই গোলাপের ঘ্রাণে খিদে বাড়ে। অথচ খিদে কমানোর ‘মাল’ অধিকাংশ সময়ই কবির পকেটে থাকে না।

যেহেতু কবিতা অর্থকরী নয়, সেহেতু বহু আগে থেকে টনটনা বিষয়বুদ্ধির বউদের কাছে লেখালেখি ছিল একটা ‘ইয়ে’। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতার কবিপত্নী কবিকে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলেছিলেন, ‘গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব/ মাথা ও মুণ্ডু ছাই ও ভস্ম/ মিলিবে কি তাহে হস্তি অশ্ব/ না মিলে শস্যকণা’। কবি ভয়ে ভয়ে বউয়ের দিকে তাকালেন। বউ বললেন, ‘অন্ন জোটে না কথা জোটে ম্যালা/ নিশিদিন ধরি এ কী ছেলেখেলা/ ভারতীরে ছাড়ি ধরো এই বেলা/ লক্ষ্মীর উপাসনা।’

সেই আমল থেকেই লেখালেখি আমজনতার কাছে ‘ছেলেখেলা’ হয়ে আছে। জনতার কথা বাদই দিলাম, ছোটকাগজ থেকে জাতীয় পত্রিকার বহু প্রকাশক ও সম্পাদকের কাছেও লেখালেখি আদতে ‘ভারতীর বিষয়’, এর সঙ্গে লক্ষ্মীর কোনো সম্পর্ক নেই। কেন এখানে ‘ভারতী’র কথাটি বললাম, একটু পরই তা সবার কাছে ফকফকা হয়ে যাবে। এর আগে এটা বলে ফেলা যাক যে এখন লেখক আছে, লেখাও আছে, শুধু ‘সম্মানী’ নেই। সম্মানীর নামে যা আছে, তা বড়জোর ‘দক্ষিণা’।

কবিকে কথা দিয়ে কথা না রাখার বদভ্যাস শুধু সুনীলের বরুণার নয়, গজনীর অধিপতি সুলতান মাহমুদেরও এই ঐতিহাসিক দোষ ছিল। কবি ফেরদৌসীকে প্রতি স্তবকের জন্য একটা করে স্বর্ণমুদ্রা সম্মানী দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন সুলতান। পরে শাহনামার ৬০ হাজার স্তবক লেখা দেখে তিনি বলেন, ‘কবি মানুষের এত সোনার টাকার কী দরকার? ওকে বরং ৬০ হাজার রুপার টাকা দাও।’ মানে প্রথম থেকেই ধরে নেওয়ার চল আছে, খালি পেটেই সাহিত্য মানায়। লেখক-কবির সঙ্গে টাকা–কড়িটা ঠিক যায় না।

লেখার জন্য লেখকদের পয়সা চাওয়া ঠিক না, এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন ভারতী পত্রিকার সম্পাদক ও রবীন্দ্রনাথের ভাগনি সরলা দেবী। তাঁর মত ছিল, সরস্বতীর কারবারে লক্ষ্মীকে টানলে সরস্বতীর অপমান হয়। এই নিয়ে নিজের মামাকেও ছাড়েননি তিনি।

প্রবাসী পত্রিকার রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে আগাম ৩০০ টাকা দিয়েছিলেন একটা উপন্যাস তাঁর পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখার জন্য। রবীন্দ্রনাথ লেখা বেচে টাকা কেন কামাই করলেন, এই অনুযোগে তাঁর সম্পাদিত ভারতীতে সরলা দেবী লিখেছিলেন, ‘প্রবাসী সম্পাদক বাল্মীিক প্রতিভার কবিকেও সরস্বতীর বিনা পণের মহল হইতে ছুটাইয়া লক্ষ্মীর পণ্যশালায় বন্দী করিয়াছেন।’

ভাগ্যিস সেবার ‘লক্ষ্মীর পণ্যশালায়’ রবিঠাকুর ‘বন্দী’ হয়েছিলেন। কারণ, সেই ৩০০ টাকার জোরে প্রবাসী পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে যে উপন্যাস লেখা শুরু হয়েছিল, তার নাম গোরা।

রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাসটিও বিচিত্রা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কিস্তিতে কিস্তিতে। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে এর জন্য একসঙ্গে দিয়েছিলেন তিন হাজার টাকা। তখনকার তিন হাজার টাকার মান এখনকার কত টাকার সমান হতে পারে, তা বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়, লেখালেখির দর কমতে কমতে এখন তলায় এসে ঠেকেছে। তাই ‘লিখে খাই’—এই কথা জোরের সঙ্গে এখন আর কেউ বলতে পারছেন না। পারছেন কি?

তবে সৃজনশীল কায়দায় কিছু লোক লেখক ও কবি পরিচয়কে অভিনব কায়দায় অর্থকরী করে তুলেছেন।

একটা নজির দিই। গাজীপুরে একটা ‘ভেজাইল্যা’ জায়গা দখল করেছেন জামাল হাসান (অবশ্যই এটি ছদ্মনাম) নামের এক লেখক ও কবি। তাঁর উপন্যাস ও কবিতার বই আছে বাজারে। তিনি তাঁর দখল করা জমির ওপর সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন। সাইনবোর্ডে লেখা, এই জায়গার প্রকৃত মালিক লে. ক. জামাল হাসান।

নামের আগের এই ‘লে. ক.’ মানে কী? এ প্রশ্নের জবাবে জামাল বললেন, ‘“লে. ক.” মানে লেখক, কবি। কেউ যদি এটাকে “লেফটেন্যান্ট কর্নেল” মনে করেন, আমার কী করার আছে!’